ভেজাল মদে চোরাই পথে আনা ‘ফ্লেভার’, বিক্রি হয় বিদেশি ব্র্যান্ডের নামে
রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকায় গত বছরের মার্চে অভিযান চালিয়ে একটি ভেজাল মদ তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। দেখা যায়, ওই কারখানায় ভেজাল মদ তৈরির পর তা বিদেশি ব্র্যান্ডের মদের বোতলে ভরে বাজারজাত করছিল একটি চক্র। বোতলজাত করার আগে ওই ভেজাল মদে বিদেশি ব্র্যান্ডের মদের স্বাদ–গন্ধের রাসায়নিক (ফ্লেভার) ও রং মেশানো হতো। অভিযানে কারখানাটি থেকে নানা স্বাদ–গন্ধের পাঁচ বোতল তরল উদ্ধার করা হয়।
ওই ঘটনায় করা মামলার তদন্ত শেষে গত বছরের আগস্টে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ডিএনসি। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভেজাল মদে মেশানো বিদেশি ব্র্যান্ডের মদের ফ্লেভার দেশের বাইরে থেকে চোরাই পথে আসছে। মূলত পুরান ঢাকায় বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এগুলো দেশে আনেন। ভেজাল মদ তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকা থেকে এগুলো সংগ্রহ করেন।
এ বিষয়ে ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্ল্যাহ কাজল প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি ব্র্যান্ডের মদের বোতল ভাঙারি দোকান থেকে কেনেন এই চক্রের সদস্যরা। আর বিদেশি ব্র্যান্ডের মদের ‘ফ্লেভার’ আসে চোরাই পথে। পরে সেসব ফ্লেভার ও রং মিশিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করা হয়। বিদেশি মদ বলে এসব ভেজাল পণ্য বিক্রি হয়।
মৃত্যু থামছেই না
ভেজাল মদ্যপানের পর মৃত্যুর ঘটনা দেশে নতুন নয়। ১৯৯৮ সালে গাইবান্ধায় পয়লা বৈশাখের প্রাক্কালে ভেজাল মদ পান করে ৭১ জনের প্রাণহানি হয়। স্থানীয় একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের কাছ থেকে রেক্টিফায়েড স্পিরিট কিনে ওই পানীয় তৈরি করা হয়েছিল। পরের বছরের মে মাসেই নরসিংদীতে বিষাক্ত মদ পানে ১১৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
সর্বশেষ গত ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে ভেজাল মদ পানের পর পাঁচজন প্রাণ হারান। এ ঘটনার পর ভেজাল মদ বিক্রি ও পানের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কুলিয়ারচরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রাথমিক তদন্তের পর তাঁরা জানান, রেক্টিফায়েড স্পিরিটের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে তৈরি ‘শক্তিবর্ধক’ মিশিয়ে পান করেছিলেন ভুক্তভোগীরা। স্থানীয় একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ‘জিনসেং’ নামের কথিত শক্তিবর্ধক মিশিয়েছিলেন। সেই চিকিৎসকও বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন।
এর আগে ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা ও গাজীপুরে ভেজাল মদ পানের পর মোট ১১ জনের মৃত্যু হয়। ওই মদ একটি চক্রের সদস্যরা সরবরাহ করেছিলেন। এসব ঘটনায় তখন ঢাকা ও গাজীপুরে ছয়টি মামলা হয়েছিল। ইতিমধ্যে এসব মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। দুটি মামলা তদন্ত করেছে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
ডিবির ভাষ্য, এই চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ভেজাল মদের নমুনায় ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত মিথানল পাওয়া গেছে। তখন গণমাধ্যমে ১১ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশিত হলেও পরে তদন্তে উঠে আসে এই চক্রের সরবরাহ করা ভেজাল মদ পানে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ভেজাল মদের দুটি মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ছিলেন ডিবির গুলশান বিভাগের তৎকালীন উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান। তিনি এখন ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসির দায়িত্ব পালন করছেন। মশিউর রহমান বলেন, এই চক্র রেক্টিফায়েড স্পিরিটের সঙ্গে গুড়সহ বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করছিল। এগুলো পান করে বিষক্রিয়ায় অনেকের মৃত্যু হয়।
রেক্টিফায়েড স্পিরিট বা মিথানল দিয়ে ভেজাল মদ
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কখনো রেক্টিফায়েড স্পিরিট, আবার কখনো মিথানল দিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করা হয়। রেক্টিফায়েড স্পিরিটের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়। এটি মূলত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি জীবাণুমুক্ত করার কাজেও এটি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা কাঠশিল্পে বার্নিশের কাজে ব্যবহৃত মিথানল দিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করেন। এটি দেখতে অনেকটাই রেক্টিফায়েড স্পিরিটের মতো। দামও কম। তবে মিথানল বিষাক্ত উপাদান, পানযোগ্য নয়।
ডিএনসির প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, রেক্টিফায়েড স্পিরিট অ্যালকোহল হলেও সরাসরি পান করা যায় না। এর সঙ্গে পানিসহ অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে নিতে হয়। অন্যদিকে মিথানল একটি বিষাক্ত উপাদান। এটি পানের পর বিষক্রিয়া হয়। ফলে অনেকের মৃত্যু হয়।
যেভাবে ভেজাল মদ ছড়ায়
প্রধানত দুটি কারণে ভেজাল মদ ছড়িয়ে পড়ছে। প্রথমত, উৎসবের সময় মদের চাহিদা বেড়ে যায়। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়াকড়ি আরোপ করলে মদের সরবরাহ কমে যায়। এরই সুযোগ নেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। দ্বিতীয়ত, ওয়্যারহাউসে কড়াকড়ি হলে বাইরে মদ আসার সুযোগ থাকে না। তখন চাহিদা পূরণে ভেজাল মদ ছড়িয়ে দেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
এ ছাড়া আরও কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে মদ আমদানিতে শুল্কহার বেশি হওয়া ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি মদ আমদানি কম হওয়া উল্লেখযোগ্য। এসব পরিস্থিতিতে দেশে ভেজাল মদ ছড়িয়ে পড়ে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কম দামে নেপাল, ভারত ও চীন থেকে নিম্নমানের মদ আমদানি করেও বিক্রি করেন।
ঢাকা ও গাজীপুরে ১১ জনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ডিবির কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর ভাটারার একটি বাসায় মিথানল ব্যবহার করে এসব ভেজাল মদ তৈরি করা হয়েছিল। চক্রের প্রধান নাসির আহমেদ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকার একটি বারে (পানশালা) কাজ করতেন। করোনা মহামারির সময় ওয়্যারহাউসগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। তখন মদের সরবরাহ কমে গিয়েছিল। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পরিচিত একজন ভাঙারি ব্যবসায়ীকে সঙ্গে নিয়ে ভেজাল মদ তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন নাসির।
ডিবির উপকমিশনার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সুযোগ কাজে লাগিয়ে নাসির আহমেদের নেতৃত্বাধীন চক্রটি অনলাইনে মদের অর্ডার নিতেন। তারপর ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বাসায় বাসায় গিয়ে তাঁরা ভেজাল মদ পৌঁছে দিতেন।
ভেজাল মদ চেনার উপায়
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘ সময় ধরে যাঁরা মদ পান করেন, তাঁদের অনেকেই বোতলের বাইরে থেকে দেখে কিংবা গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারেন যে সেটি আসল মদ, নাকি ভেজাল। অন্যদের পক্ষে আসল ও নকল মদের পার্থক্য করা সব সময় সম্ভব হয় না। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মদের ভেজাল নির্ণয় করার নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি নেই। তবে একটি সহজ উপায়ে মদে ভেজালের উপস্থিতি নির্ণয় করা যেতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পানশালার কর্মচারী জানান, সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি একটু মদ নিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে পরীক্ষা করা। মিথানল ব্যবহার করে ভেজাল মদ তৈরি করতে হলে তাতে সামান্য পরিমাণ হলেও পানি দিতে হবে। এক ফোঁটা পানি থাকলে ওই মদে আগুন জ্বলবে না। কাজেই মদে যদি আগুন না জ্বলে, তাহলে ধরে নিতে হবে সেটি ভেজাল।